সকল পেশাজীবীদের তুলনায় ডাক্তারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে সেখানে গড়ে প্রতিদিন একজন ডাক্তার আত্মহত্যা করেন, অর্থাৎ বছরে ৩৬৫ জন ডাক্তার আত্মহত্যা করেন। মেডিকেল কলেজের একেকটি ব্যাচে সাধারণত ১০০-২০০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় মেডিকেল কলেজের ২টি ব্যাচের সমান ডাক্তার শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশে সঠিক কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও সারা পৃথিবীর মত এখানেও ডাক্তারদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। মেটা এনালাইসিসে দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার যেখানে প্রতিলাখে প্রায় ১২ জন, ডাক্তারদের মধ্যে এই হার প্রতি লাখে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের থেকে ২-৪ গুন বেশি হারে ডাক্তাররা আত্মহত্যা করেন। প্রশ্ন উঠতে পারে ডাক্তারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার এত বেশি কেন? গবেষকরা এর কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
প্রথম কারণটি হচ্ছে স্ট্রেস। ডাক্তারদের কাজের স্ট্রেস অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে বেশি। স্ট্রেস এর কতগুলো কারণ বের করা হয়েছে। যেমন একই সাথে একাডেমিক পড়াশুনা এবং কাজ করা, লম্বা সময় ধরে কাজ করা, প্রচণ্ড পরিশ্রম করা, কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় বা রুটিন না থাকা, নাইট ডিউটি করা, ইমারজেন্সি ডিউটি করা, অন কল ডিউটিতে থাকা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, পরিবারকে সময় দিতে না পারা, সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক ভাল না থাকা ইত্যাদি। মেয়ে ডাক্তারদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত স্ট্রেস হিসেবে যুক্ত হয় একই সাথে পারিবারিক এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করা এবং ঐতিহ্যগত ভাবে মেডিকেল সেক্টরে মেয়েদের ছোট করে দেখা।
স্ট্রেস এর পরে গবেষণায় যে কারণটি বের হয়ে আসছে তা হচ্ছে ডিপ্রেসান বা বিষণ্ণতা। ডাক্তারদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রায় ৬ গুন বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ৩০ শতাংশ ডাক্তার বিষণ্ণতায় ভোগেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ২৪% মেডিকেল স্টুডেন্ট আত্মহত্যার চিন্তা করে। ডাক্তারদের মধ্যে আবার নারী ডাক্তারদের বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার হার পুরুষদের দ্বিগুণ। ডাক্তারদের পাশাপাশি নার্সরাও প্রায় একই হারে আত্মহত্যা করে থাকেন।
স্ট্রেস ও বিষণ্ণতার পরে যে কারণটি চিহ্নিত করা হয়েছে তা হল ব্যক্তিত্বের ধরণ। অতিরিক্ত দায়িত্বশীল আচরণ, খুঁতখুঁতে স্বভাব, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় মনে রাখা ও নজর দেয়ার প্রবণতা; এই ধরণের ট্রেইট থাকার কারণে ডাক্তারদের মধ্যে স্ট্রেস এবং বিষণ্ণতার হার বেশি। স্ট্রেস এবং বিষণ্ণতা মানুষের ডোপামিন এবং সেরেটোনিন লেভেল কমিয়ে দিয়ে মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলে।
চতুর্থ যে বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে তা হল আত্মহত্যার পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা। ডাক্তাররা তাদের পেশাগত জ্ঞানের কারণে কিভাবে আত্মহত্যা করা যায়, কোন ওষুধের লিথাল ডোস কত, শরীরের কোথায় কোথায় আঘাত করলে মানুষ মারা যেতে পারে এই সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রাখেন। তাছাড়া পেশাগত কারণে তারা খুব সহজেই ওষুধ ম্যানেজ করতে পারেন। জ্ঞান এবং পদ্ধতির সহজলভ্যতার কারণে ডাক্তারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি।
পঞ্চম যে কারণটি পাওয়া গেছে তা হচ্ছে মৃত্যু ভয় কমে যাওয়া। প্রতিনিয়ত অসুস্থতা এবং মৃত্যু দেখতে দেখতে ডাক্তারদের মধ্যে নিজেকে আঘাত করার ভয় কমে যায়। একজন সাধারণ মানুষের কাছে মৃত্যু যত ভয়ঙ্কর বারবার দেখার ফলে তা ডাক্তারদের জন্য কম ভয়ঙ্কর; এর ফলে তাদের জন্য আত্মহত্যার চিন্তা করা সহজ হয়।
আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। আপনি যদি আত্মহত্যাপ্রবণ হন তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন, সাহায্য নিন।